বিজ্ঞান এবং মহাকাশ ভ্রমণের জগতে ২০২৩ সালে ঘটেছে কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা। ঘটনাগুলো যেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর উপন্যাস থেকে উঠে এসেছে।
বেন্নু নামে গ্রহাণু থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে নাসার অসিরিস-রেক্স ক্যাপসুল। ছবি: নাসা
বিজ্ঞান এবং মহাকাশ ভ্রমণের জগতে ২০২৩ সালে ঘটেছে কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা। ঘটনাগুলো যেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর উপন্যাস থেকে উঠে এসেছে।
দেখে নেওয়া যাক ২০২৩ সালের মহাকাশের সবচেয়ে নজরকাড়া কয়েকটি মুহূর্ত।
অ্যাক্সিয়ম-২ মিশনে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন ভ্রমণে যাওয়া চারজন। ছবি: অ্যাক্সিয়ম স্পেস
মহাকাশে পর্যটন
শখের তোলা আশি টাকা। তবে আপনার শখ যদি হয় মহাকাশ ভ্রমণ? সামর্থ্য থাকলেও সেটি পূরণ করা কয়েক বছর আগেও ছিল অসম্ভব।
কিন্তু আমরা এখন এমন এক যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে কারও সামর্থ্য থাকলেই তিনি মহাকাশে ভ্রমণ করতে পারবেন। মূলত ২০২৩ সালের মে থেকে অ্যাক্সিয়ম-২ এর হাত ধরে মহাকাশ পর্যটন শুরু হয়। সেবার নাসার প্রাক্তন মহাকাশচারী পেগি হুইটসন এবং তিনজন গ্রাহক আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভ্রমণ করেন। তবে অনুরূপ ভ্রমণের জন্য প্রতি আসনের জন্য খরচ পড়বে ৫৫ মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে, ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্র্যানসন মহাকাশ পর্যটনের জন্য ভার্জিন গ্যালাকটিক নামে আরেকটি উদ্যোগ চালু করেছেন। ২০২৩ সালে ভার্জিন গ্যালাকটিক সাব-অরবিটাল রকেট-চালিত মহাকাশ বিমানের মাধ্যমে মহাকাশের প্রান্তে ছয়টি ভ্রমণ করেছে। এখানে প্রতি আসনের জন্য যাত্রীদের খরচ করতে হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
এদিকে, জেফ বেজোসের মহাকাশ পর্যটন সংস্থা ব্লু অরিজিনও ২০২৩ সালে তাদের সাব-অরবিটাল রকেট সফলভাবে উৎক্ষেপণ করেছে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে জন্মানো সবজি নিয়ে কাজ করছেন নাসার মহাকাশচারী ফ্রাঙ্ক রুবিও। ছবি: নাসা
মহাকাশে নভোচারীর এক বছর
নাসার মহাকাশচারী ফ্রাঙ্ক রুবিও’র আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ছয় মাস কাটানোর কথা ছিল। কক্ষপথে যাতায়াতের জন্য তিনি রাশিয়ান সয়ুজ মহাকাশযানে ছিলেন। তবে মহাকাশযানটির একটি কুল্যান্ট ফুটো হয়ে গেলে রাশিয়াকে আরেকটি যান পাঠাতে হয়। যার কারণে রুবিও’র ফিরে আসতে ছয় মাস বিলম্বিত হয়। ৩৭১ দিন মহাকাশে কাটানোর পর অবশেষে সেপ্টেম্বরে পৃথিবীতে পা রাখেন তিনি। যা তাকে এনে দেয় মার্কিন নভোচারীদের মধ্যে মহাকাশে একটানা সর্বোচ্চ সময় কাটানোর রেকর্ড।
তবে রুবিওকে নিয়ে একটি হালকা কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটে গেছে। কক্ষপথে জন্মানো প্রথম টমেটোগুলোর মধ্যে একটি হারিয়ে গেলে, তিনি সেটি ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছিলেন বলে অনেকে সন্দেহ করেন। মূল্যবান এই সম্পদটি যদিও পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া গেছে। তখন অবশ্য তাকে এ অভিযোগ অব্যাহতি দেওয়া হয়।
স্পেসএক্সের সবচেয়ে শক্তিশালী মার্স রকেট উৎক্ষেপণ। ছবি: এএফপি
স্পেসএক্সের মার্স রকেট বিস্ফোরণ
এ বছর এখন পর্যন্ত নির্মিত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট উৎক্ষেপণ করেছে স্পেসএক্স। তবে দুই বারের প্রচেষ্টা বিফলে গেছে এবং রকেটগুলো বিস্ফোরিত হয়েছে।
প্রথমবারের মতো মঙ্গল গ্রহে মানুষ নেওয়ার জন্য স্টারশিপ নামে একটি রকেট এবং মহাকাশযান সিস্টেম চালু করেছে স্পেসএক্স। এপ্রিলে প্রথম প্রচেষ্টায় রকেটটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করলে স্পেসএক্স এটিকে ধ্বংস করতে বাধ্য হয়। নভেম্বরে দ্বিতীয় প্রয়াসে যানটি আরও অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু মহাকাশযান ও রকেট বুস্টার উভয়ই শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরিত হয়।
তবে পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণের দুর্ঘটনাগুলো যে স্পেসএক্সের জন্য বড় ধরনের কোনো বিপত্তি নিয়ে এসেছে এমনটি নয়। কেননা প্রতিষ্ঠানটি রকেট উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে এরকম ব্যর্থতা আলিঙ্গনের জন্য আগে থেকেই পরিচিত।
২০২৫ সালের মধ্যে স্পেসএক্স নাসার জন্য চাঁদে মহাকাশচারী পাঠানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি, ইলন মাস্ক আশা করছেন ২০২৯ সালের মধ্যে মানুষকে মঙ্গলে পৌঁছে দেবে স্টারশিপ।
চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণকারী ভারতের চন্দ্রযান-৩। ছবি: নাসা
চাঁদে অবতরণের নতুন প্রতিযোগিতা
চাঁদে অবতরণ নিয়ে আবার নতুন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তবে এবারের অংশগ্রহণকারীরা সবাই রোবট।
প্রতিযোগিতাটি এপ্রিলে শুরু হয়, যখন আইস্পেস নামে জাপানের এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রথম বাণিজ্যিক যান হাকুটো-আর ল্যান্ডার-কে চাঁদে অবতরণের চেষ্টা করে। যদিও শেষ পর্যন্ত অবতরণে সময় সেটি ধ্বংস হয়ে যায়। রাশিয়ার স্পেস এজেন্সিও (রসকসমস) আগস্টে তাদের লুনা-২৫ মিশনটি সফল করতে ব্যর্থ হয়।
তবে এর কিছুদিন পরই ২৩ আগস্ট ভারতের মহাকাশ সংস্থা (ইসরো) চন্দ্রযান-৩ সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করায়। চাঁদে মহাকাশযান সফলভাবে অবতরণের ক্ষেত্রে ভারত চতুর্থ দেশ। তবে চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণকারী হিসেবে প্রথম দেশ হয়ে উঠে ভারত।
অপরদিকে, জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সিও চাঁদে অবতরণের উদ্দেশ্যে একটি মহাকাশযান পাঠিয়েছে। যা আগামী বছরের শুরুর দিকে অবতরণ করবে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের প্রকাশ করা ভিডিওতে আন আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট (ইউএফও)। ছবি: পেন্টাগন
নাসা প্রকাশিত প্রথম ইউএফও রিপোর্ট
অজ্ঞাত অস্বাভাবিক ঘটনা অধ্যয়নের জন্য নাসা একটি বিশেষজ্ঞের দল গঠন করে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। দলটি মূলত আন-আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট (ইউএফও) নিয়ে অধ্যয়ন করছে। দলটি সেপ্টেম্বরে একটি প্রতিবেদনে তাদের প্রথম ফলাফল প্রকাশ করেছে।
দলটি জানায়, অনেক বিশ্বাসযোগ্য প্রত্যক্ষদর্শী এবং প্রায়শই সামরিক পাইলটরা আকাশে এমন সব বস্তু দেখেছেন, যেগুলো তারা চিনতে পারেননি। যদিও বেশিরভাগ ঘটনার রহস্য সমাধান হয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা পরিচিত মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করা যায়নি।
তবে ঘটনাগুলো কোনো বুদ্ধিমান এলিয়েন ঘটিয়েছে, এরকম কোনো শক্ত প্রমাণও দলটি এখন পর্যন্ত পায়নি।
আর্টেমিস ২ মুন মিশন পরিচালনার জন্য বাছাই করা চার নভোচারী। ছবি: এএফপি
আবার চাঁদে পা ফেলবে মানুষ
পাঁচ দশক পর চার মহাকাশচারী আবার চাঁদের বুকে পা ফেলবে বলে জানিয়েছে নাসা। ২০২৩ সালের এপ্রিলে তারা আর্টেমিস ২ মুন মিশনটি সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করে এবং নভোচারীদের বাছাই করে।
২০২৪ সালের নভেম্বরে এটি টেক-অফের জন্য প্রস্তুত হবে বলে জানানো হয়। বলা হচ্ছে, এই যাত্রার পরের গন্তব্য হবে মঙ্গল গ্রহ। আর্টেমিস ২ মিশনের একটি লক্ষ্য হচ্ছে, চাঁদে একটি স্থায়ী ফাঁড়ি স্থাপন। যেখানে মহাকাশচারীরা থাকতে এবং কাজ করতে পারবেন। যা একসময় মঙ্গল গ্রহে ক্রু মিশনগুলোর পথ প্রশস্ত করবে।
উটাহ মরুভূমিতে অবতরণ করা নাসার অসিরিস-রেক্স ক্যাপসুল। ছবি: নাসা
অসিরিস-রেক্সের বিশেষ ডেলিভারি
২০২৩ সালে একটি মহাকাশযান পৃথিবীতে মহাকাশ থেকে গ্রহাণুর টুকরো নিয়ে আসে। যাতে থাকতে পারে সৌরজগতের লুকিয়ে থাকা চমকপ্রদ সব তথ্য।
নাসার অসিরিস-রেক্স ক্যাপসুল মহাকাশের গ্রহাণু থেকে পাথর, ধূলিকণাসহ বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করে থাকে। ২০২০ সালে বেন্নু নামক গ্রহাণু থেকে সফলভাবে একটি নমুনা সংগ্রহ করে ক্যাপসুলটি।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ক্যাপসুলটি উটাহ মরুভূমিতে অবতরণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি মহাজাগতিক ধাঁধায় ফেলে দেয়। ক্যাপসুলটির নিয়ে আসা সম্পদগুলো বিজ্ঞানীদের ধারণার বাইরে ছিল।
প্রাথমিক বিশ্লেষণে জানা যায়, ক্যাপসুলটির আনা শিলা এবং ধূলিকণাগুলোতে পানি এবং প্রচুর পরিমাণে কার্বন রয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টির পেছনে গ্রহাণুগুলোর অবদান থাকতে পারে। এর বাইরেও নতুন অনেক তথ্য নিয়ে হাজির হয়েছে এই ক্যাপসুলটি। বিজ্ঞানীরা যেগুলো পরীক্ষা করে দেখছেন।
পরিশেষে, মহাকাশ অনুসন্ধানে নাসা এবং মার্কিন সরকারের বাইরেও ভারত এবং চীনের মতো দেশগুলো থেকেও বিভিন্ন প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া, বিশ্বজুড়ে ব্যক্তিগত খাত থেকেও এই ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগ হচ্ছে। যার কারণে আমাদের সামনে আসছে আশ্চর্যজনক সব আবিষ্কার।
তথ্যসূত্র: সিএনএন, গ্রন্থনা: আহমেদ বিন কাদের অনি